ইউরোপিয়ান সুপার লীগ- ফুটবল দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে এই টুর্নামেন্টের নাম নিয়ে। স্রেফ ইউরোপিয়ান প্রথিতযশা ক্লাবগুলোর জনপ্রিয়তাকে ভিত্তি করে এর নকশা করা। এগুলো মলাটের কথা, এবার জানা যাক ভেতরের কথাগুলো!
ইতিহাস-
উইকিপিডিয়া অনুসারে, বহু আগে, ১৯৯৮ সালে ইতালিয়ান মিডিয়া কোম্পানি পার্টনাররা এর আইডিয়া বের করেছিলেন। কিন্তু উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগকে বড় করায় এবং উয়েফা কাপ উইনার্স কাপ (সাম্প্রতিক সময়ের উয়েফা কাপ চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে টুর্নামেন্টটি হত) বিলুপ্ত করায় আইডিয়াটা সেবার মাঠে মারা পড়ে।
বছর দশেক পরে, ২০০৯ এর দিকে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আবারও তোলেন সুপার লীগের কথা। পেরেজের প্রস্তাব ছিল- ইউরোপের এলিট ক্লাবগুলোর নিজস্ব একটা লীগের ব্যাপারে একমত হওয়া উচিত, যেখানে বেস্ট অফ বেস্ট ক্লাবগুলো নিয়মিত খেলতে পারবে। হয় উয়েফা ব্যবস্থাটা করে দিক, এলিট টিমগুলোকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে অটো কোয়ালিফাই করিয়ে কিংবা আমরা নিজেরাই আলাদা কোন সুপার লীগ তৈরি করি। সুপার লীগে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের এলিট টিমগুলো লীগের আদলে নিয়মিত ম্যাচ খেলবে, পাশাপাশি নিজেদের ঘরোয়া লীগ-কাপে তো খেলবেই।
সেই সময় আর্সেন ওয়েঙ্গার, এর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিভিন্ন কন্টিনেন্টে এলিট টিমগুলো রেভিনিউ আকাশ-পাতাল ভাবে ওঠা-নামা করে। ক্লাবগুলোর নিজেদের স্বার্থেই একত্র হয়ে আলাদা লীগ চালু হওয়া উচিত।
ওয়েঙ্গার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন- বছর দশেকের মধ্যে এটা চালু হতে পারে।
ইউরোপিয়ান কিংবদন্তি সিডর্ফসহ আরও বিভিন্ন ফুটবল খেলোয়াড়রা এর পক্ষেই কথা বলেছিলেন।
কী হবে টুর্নামেন্টের উদ্দেশ্য?
মূল উদ্দেশ্য উপরের ইতিহাস পড়েই অনেকটা বোঝা গেছে। তাও এক কথায় পরিষ্কার করে বললে- ইউরোপের এলিট/প্রথিতযশা ক্লাবগুলো এক হয়ে একটি লীগের আয়োজন করতে চায়, যেটায় তারা নিয়মিত প্রতি বছর একে অপরের বিরুদ্ধে খেলতে পারে।
এর মূল কারণ, ক্লাবগুলো মনে করে তাদের রেভিনিউ আগের তুলনায় সেভাবে বাড়েনি। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে অনেক নতুন দলের উত্থানের কারণে ইউনাইটেড, মিলান, আর্সেনাল ইত্যাদির মত জনপ্রিয় ফ্যানবেজের দলগুলো সেখানে খেলার যোগ্যতা হারিয়েছে, ফলে দলগুলোর টিভি স্বত্ব, স্পন্সর সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা লাভের মুখ দেখছে না। সুপার লীগে নিয়মিত খেলা নিশ্চিত হলে, বিশ্বব্যাপী এদের যে বিশাল ফ্যানবেজ আছে তাদেরকে কেন্দ্র করে প্রচুর আর্থিক উন্নতি করা সম্ভব।
অর্থাৎ একদম মৌলিক কারণ বলতে গেলে- রাতারাতি ক্লাবগুলোর আর্থিক উন্নতি করা।
এবার জানা যাক, কোন এলিট টিমগুলো খেলবে এতে?
প্রাথমিকভাবে- রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল, টটেনহাম এই ১২ টা দল সুপার লীগের জন্য চূড়ান্ত সম্মতি জানিয়েছে। না করে দিয়েছে- পিএসজি এবং বায়ার্ন মিউনিখ।
টুর্নামেন্টের ডিজাইন ২০ দলকে নিয়ে। এর মধ্যে ১৫ দল হবে পার্মানেন্ট মেম্বার অর্থাৎ এরা যতই খারাপ খেলুক সবসময় লীগে থাকবেই। বাকি ৫ টা দলকে ইউরোপের বিভিন্ন লীগ থেকে আমন্ত্রণ করা হবে, এরা নির্দিষ্ট না। অর্থাৎ একেক সিজনে ভিন্ন ভিন্ন ৫ টা দলকে দেখা যেতে পারে আবার আগের সিজনের ৫ টা দলই থাকতে পারে!
টুর্নামেন্টের কী হবে ফরম্যাট?
২০ দল দুই গ্রুপে ভাগ হবে, প্রতি গ্রুপের ১০ দল লীগের মত হোম-অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে খেলবে। গ্রুপ দু'টোর টপ ফোর খেলবে দুই লেগের কোয়ার্টার-ফাইনাল, সেখান থেকে দুই লেগের সেমি-ফাইনাল এবং এক ম্যাচের ফাইনাল হবে।
দলগুলো কি নিজ নিজ ঘরোয়া লীগ খেলবে?
প্রথমে দলগুলো নিজেদের ঘরোয়া লীগ খেলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই জায়গা থেকে সরে আসে। কারণ, ঘরোয়া লীগের ম্যাচের দিনক্ষণ এবং সুপার লীগের ম্যাচের দিনক্ষণে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।
এই লীগ নিয়ে ফিফা এবং উয়েফার অবস্থান কী?
যেহেতু এটা সম্পূর্ণই এলিট দলগুলোর নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে হচ্ছে- তাই ফিফা এবং উয়েফা কারোরই এতে সম্মতি নেই। ফিফা সহ বাকি সব আঞ্চলিক ফেডারেশন মনে করে- এই টুর্নামেন্ট ফুটবলের জন্য ক্ষতিকর। কেননা টাকার ঝনঝনানিতে ফুটবল তখন শুধু এই ক্লাবগুলো কেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যম ও ছোট সারির দলগুলো।
তাই এই টুর্নামেন্টটি বন্ধ করতে ফিফা এবং উয়েফা বিভিন্নরকম হুমকিও দিয়েছিল। তাতেও এর অগ্রগতি বন্ধ না হওয়ায়, দু'টি ফেডারেশনই মিলিতভাবে জানিয়েছে যে-
"এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া দলগুলো তাদের নিজস্ব ঘরোয়া লীগ এবং কোনরকম ইউরোপিয়ান ও ফিফার ক্লাবকেন্দ্রিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারবে না। এই দলগুলোয় খেলা প্লেয়াররাও উয়েফা এবং ফিফার কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারবে না। অর্থাৎ খেলোয়াড়দের উপর ইন্টারন্যাশনাল ব্যানও কার্যকর হবে, সে যে অঞ্চলেরই হক না কেন!"
তবে যেহেতু এটা আগামী সিজন থেকে চালু হবার পরিকল্পনা, তাই এই সিজনের ইউরো এবং কোপা আমেরিকার ক্ষেত্রে এই ব্যান কার্যকর হবার কথা না। ২০২২ এর বিশ্বকাপ তো বটেই, সুপার লীগ শুরু হবার পর থেকেই খেলোয়াড়রা আর জাতীয় দলের জন্যে বিবেচ্য হবে না।
এতক্ষণ জানলেন সুপার লীগের সারমর্ম। এবার আমার মতামত জানাই, আমি ব্যক্তিগতভাবে ফুটবলের এমন সিন্ডিকেটের বিপক্ষে। এতে ফুটবলের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। লাভ শুধুমাত্র ক্লাবগুলোর পকেটেই যাবে, তারা ফুলে-ফেঁপে আরও ধনী হবে। কিন্তু আয়াক্স কিংবা হালের আটালান্তার মত দলগুলোর কাঠামো ভেঙে পড়বে।
যদিও উয়েফা আর ফিফার ব্যান থাকায়, অনেক খেলোয়াড়রাই হয়ত থাকতে চাইবে না। তবুও টাকায় কিনা হয়! বিশাল অংকের স্যালারি ডিম্যান্ড করে খেলোয়াড়রাও নিজেদেরকে এলিট দলগুলোয় রাখবে। এগুলো সিন্ডিকেটের ১২ টা দল খুব ভালো করেই জানে।
যদিও অনেকে বলছেন যে ফিফার ব্যানের কারণে শেষ পর্যন্ত এটা মাঠে গড়াবে না। সত্যি বলতে, এই সিন্ডিকেট এগুলো সব জেনে বুঝেই এগোচ্ছে। তারা আগেই জানত এমন ব্যান আসতে পারে। এমন ইঙ্গিত বহু আগে থেকেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা নেগোসিয়েশনে যায়নি ফেডারেশনগুলোর সাথে। নিজেদেরকে সুপিরিয়র প্রমাণ করার নেশায় যেকোন কিছুকে ইগনোর করতে তারা রাজী।
এখন যদি নেগোসিয়েশন করতেই হয়- ফিফা এবং উয়েফাকে নরম হয়ে এদের সঙ্গে বসতে হবে। সেটা কি সম্ভব? এই মুহূর্তে বোধহয় সম্ভব না। যদি ফিফা-উয়েফা দেখে এই লীগে যেই খেলোয়াড়রা খেলতেছে তারা না থাকায় তাদের ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন রঙ হারাচ্ছে, তখনই তারা নেগোসিয়েশনে যাবে। যদি রঙ না হারায়, সেক্ষেত্রে এরাও নরম হবার কথা না।
তাহলে লীগ কি শেষ পর্যন্ত হবেই?
এখন পর্যন্ত আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে- লীগটাকে যেকোনভাবেই এরা মাঠে গড়াতে চায়। স্পেশালি এই করোনার জন্যে ছোট দলগুলোর চেয়ে বড় দলগুলোর বেশি ক্ষতি হয়েছে, এটা পুষিয়ে নিতে যত তাড়াতাড়ি মানি-মেশিন চালু করা যায় ততই ভালো।
যদি শেষ পর্যন্ত লীগগুলো ফেইল করে তাহলে?
লীগ ফেইল করার বড় কারণ একটা হতে পারে যে- স্টার প্লেয়াররা যদি নিজেদের দল থেকে এই লীগ বয়কট করে। বা ন্যাশনাল টিমকে প্রাধান্য দিয়ে দল ছেড়ে দেয়। সেক্ষেত্রে স্টার রেভিনিউ অনেকটাই কমে যাবে। অর্থাৎ আর্থিক লাভ যখন ঠিকময় উঠবে না, তখনই দলগুলো লীগ চালানো যাবে কিনা সেটা নিয়ে ভাববে। কিন্তু ততক্ষণে এই বড় ক্লাবগুলো এক ধাক্কায় বিশাল পিছিয়ে যেতে পারে। ফিফা-উয়েফা নরম না হলে সহজে ঘরোয়া লীগে ব্যাকও করতে পারবে না। আবার আর্থিক ভরাডুবিও থাকবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হতে পারে এসি মিলান-ইন্টার-আর্সেনাল-টটেনহামের। ক্লাবগুলো এমনিতেও ঘরোয়াতে নিজেদেরকে ফিরে পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, অন্য দলগুলোর তুলনায় এদের স্ট্র্যাকচারও খারাপ- ফলে লীগ ব্যর্থ হলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে এরাই।
এই আলোচিত-সমালোচিত টুর্নামেন্ট আদৌ মাঠে গড়াবে কিনা, তা জানা যাবে আজ ভোরে।